Thursday, May 3, 2012

নবাব সিরাজদৌল্লা বনাম মীরজাফর - এক নিরপেক্ষ মূল্যায়ণের প্রয়াস

সিরাজদৌল্লা
দু-তিনদিন আগেই একজন ভদ্রলোকের সাথে অনলাইনে আলোচনা হচ্ছিলো। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো ভারতে ইংরেজদের ব্যবসা করতে আসা এবং সময়-সুযোগমত রাজা হয়ে বসা। এই যখন আলোচনার বিষয়, তখন ১৭৫৭ সালের কথা তো উঠবেই। আর ১৭৫৭ এর পলাশীর যুদ্ধের কথা উঠলেই আমাদের কাছে রেডিমেড ট্র্যাজিক হিরো আর ভিলেনও হাতেগরম হাজির - সিরাজদৌল্লা আর মীরজাফর। হিরোপূজার আতিশয্যে সিরাজকে, বিশেষতঃ বাঙ্গালিরা, মোটামুটিভাবে অরণ্যদেবের মতন এক আদর্শ যোদ্ধা, নেতাজির মতন স্বাধীনতা সংগ্রামের অধিনায়ক আর বিবেকানন্দের কাছাকাছি দৃঢ় চরিত্রের লোক বলে বর্ণনা করতেই ভালবাসেন। আর মীরজাফর হলো গব্বর সিং, শাকাল, মোগাম্বো, নাথুরাম গডসে - এদের সবার সংমিশ্রণে তৈরী এক সুপার ভিলেন। এ এক এমনই ভিলেন, যে মোটামুটি অপরাজেয় হিরোকেও হার মানতে বাধ্য করে। তারপর সেই হিরোর মুণ্ডচ্ছেদও করে ফেলে। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় কল্পনাশ্রিত মিথ, যার সঙ্গে হয়তো সত্যিকারের ইতিহাসের কোনও সম্পর্কই নেই।
battle of plassey 1757
মীরজাফর
যদিও পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের জন্য শুধুমাত্র মীরজাফরই দায়ী ছিলেন না, আরো অনেক প্রভাবশালী ষড়যন্ত্রকারীর মাঝে মীরজাফরও অন্যতম ছিলেন, কিন্তু সেই যে যুদ্ধের সময় থেকে বাংলায় এবং পরবর্তীতে মোটামুটি সমস্ত ভারতেই মীরজাফরের গায়ে বিশ্বাসঘাতকতার ছোপটা লেগে গেলো, আজ পর্যন্তও সেটাকে ওঠানো যায় নি। আর বাংলা ভাষাতে মীরজাফরের মানেই দাঁড়িয়ে গেলো বিশ্বাসঘাতক। 
siraj ud doula, mirjafar
আবার সেই অনলাইন আলোচনায় ফিরে যাই। কথায় কথায় মীরজাফরের সমাধি ক্ষেত্রের কথা উঠলো। ভদ্রলোক আমাকে একটা অদ্ভুত জিনিস জানালেন। মীরজাফরের কবরের গায়ে নাকি লেখা রয়েছে যে "জুতো পরে কবরের ওপরে উঠুন"। আশ্চর্য তো! কারন আমার জানা মতে কারো কবর, মাজার বা সমাধিক্ষেত্রে গেলে, মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান জানিয়ে জুতো খুলে রাখতে হয়। কিন্তু এই কবরে শুয়ে থাকা লোকটার নাম যে মীরজাফর, তাই মরার পরও বেচারার শান্তি নেই। এখনো রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে ম্যাচ ফিক্সিং-এর মূল্য চুকিয়ে যেতে হচ্ছে।
robert clive mir kashim
প্রসংগতঃ বলে রাখি যে আমি কোনও ইতিহাসবিদ নই। ক্লাস সেভেনে থাকতেই প্রথাগত ইতিহাস পড়াশুনোর ইতি ঘটেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে, নিজের খেয়ালে একটু আধটু পড়াশোনা করেছি বৈকি। আর ইংরেজ এবং ভারতীয় - দুই পক্ষেরই ইতিহাসবিদদের লেখাটেখা পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে সিরাজ কোনও ধোয়া তুলসীপাতা মোটেও ছিলেন না। আজকের দিনে বসে সিরাজের কীর্তিকলাপের হিসেব-নিকেশ করলে সিরাজ আর ইদি আমিনের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্যই পাওয়া যাবে না। কাজেই সিরাজকে সৎ, সাহসী, স্বাধীনতা সেনানী নায়ক বানানোর (অপ)চেষ্টাকে সম্পূর্ণ মিথ্যাচারই বলতে হবে। অন্যদিকে, মীরজাফর সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এরকম বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস পৃথিবীর সব দেশে, সব রাজ পরিবারের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। সেই হিসেবে মীরজাফরের জামাতা মীরকাশিমও বিশ্বাসঘাতক এবং মীরজাফরের চাইতে আরেক ধাপ বড় বিশ্বাসঘাতক। কারন সিরাজের সাথে মীরজাফরের ঐরকম কোনও আত্মীয়তা অন্ততঃ ছিলোনা। আওরঙজেবকে অনেক কিছুর জন্যই খলনায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু লিস্টের প্রথমদিকে অন্ততঃ নিজের ভাইদেরকে মেরে রাজত্ব দখল করার ইতিহাস আসে না। রাণী ভিক্টোরিয়া থেকে সম্রাট - এবং তথাকথিত মহামতি - আকবর পর্যন্ত সব মহাদেশের সব রাজত্বেই এরকমভাবে ম্যাচ ফিক্সিং-এর অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। মীরজাফরের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভুলটা হলো, ১৭৫৭ সালে বসে ভদ্রলোকের পক্ষে বিচার-বিবেচনা করে বুঝতে না পারা যে আর মাত্র একশো নব্বুই বছর পরেই পুরো আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে একটা দেশ তৈরী হয়ে যাবে, যেটার নাম হবে ভারতবর্ষ। ব্যাপারটাকে আমরা ভারতের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে না দেখলেই আর অতো সিরিয়াস লাগে না।
nawab of bengal
আর, বাংলার ঘরে ঘরে শিশুপাঠ্য ইতিহাসে সিরাজকে যেভাবে এক মহান চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়, সেটা নিরানব্বুই শতাংশই ভুল। সিরিয়াস ইতিহাসে যে সিরাজকে পাওয়া যায়, তা থেকে মনে হয় যে মীরজাফর বা ক্লাইভ নিমিত্তমাত্র। পলাশীর যুদ্ধ না হলেও সিরাজ কোন না কোন দিন কোনও মেয়ের বাবা, ভাই বা বাগদত্তের হাতে নিহত হতোই। সিরাজের চারিত্রিক বৈশিষ্টই ছিল লাম্পট্য, মদের নেশায় ডুবে থাকা, লোককে বিশ্বাস করতে না পারা, কোনও কারন ছাড়াই যেকোনও কাউকে অপমান করা ইত্যাদি। এছাড়াও সিরাজের আরেকটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট ছিলো এক পাশবিক নিষ্ঠুরতা, যার বহিঃপ্রকাশের উদাহরণ অনেকের লেখাতেই পাওয়া যায়। সিরাজ নিজেকে অন্যদের চেয়ে উঁচুস্তরের মানুষ বলে মনে করতো আর তার কাছে বাকি সবাই ছিলো নিম্নস্তরের প্রাণী। সিরাজের এই অভদ্র আচরণ থেকে কেউই রেহাই পেতো না। আলিবর্দীর সময়ের বিশিষ্ট লোকদের সিরাজ সবার সামনেই অপমান করতো এবং প্রত্যেককে একটা করে অপমানজনক ডাকনামও দিয়েছিলো। সিরাজের নজরে কার মেয়ে কখন পড়ে যায়, এই ভয়ে সবাই কাঁটা হয়ে থাকতো। আর সিরাজ যে ছল-চাতুরিও ভালোভাবেই জানতো সেটাও ইতিহাসেই পাওয়া যায়। সবার সাথে এরকম দুর্ব্যবহার করার পরেও আলিবর্দীর সামনে সিরাজ একদম ভাজা মাছটা উলটে খেতে পারে না, নিজের এরকম একটা ভাবমূর্তি বজায় রেখেছিলো। যার জন্য আলিবর্দীকে কেউ কিছু বলে থাকলেও তিনি সেটা বিশ্বাস করার কোন কারণই দেখেননি। আজকের দিনে সবাই এই লম্পট, চরিত্রহীন, ধূর্ত, অত্যাচারী সিরাজকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী নবাব হিসেবে তুলে ধরেন। এটাই আশ্চর্য!
battle of plassey 1757
মীরজাফরের সমাধি
আর মীরজাফরকে যে ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধান আসামী করা হয়, তাতে আরো অনেকেরই হাত ছিলো। জগৎ শেঠ অর্থাৎ মেহতাব চাঁদ ও স্বরূপ চাঁদ, নবকৃষ্ণ, ইয়ার লতিফ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, উমিচাঁদ, রায় দুর্লভ, ঘসেটি বেগম - এরা সবাই ষড়যন্ত্রের সমান ভাগী। আর এদেরকে দোষ দেওয়ার আগে এদের ব্যক্তিগত অবস্থাটাও একবার ভেবে দেখা উচিত। মানসিকভাবে অস্থিতিশীল সিরাজ কবে যে কার মুণ্ডুচ্ছেদের হুকুম দেবে এই নিয়েই এরা ভয়ভীত হয়েছিলো। নিজেদের বেঁচে থাকার জন্যই এদের কাছে সিরাজের মৃত্যু প্রয়োজন ছিলো। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের ভাগীদার হয়ে সিরাজকে ক্ষমতাচ্যূত করা - এটাই এই গ্রুপের লোকেদের কাছে একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে এদের মধ্যে বেশ কিছু লোক আজকেও মোটামুটিভাবে হিরোর ভাবমূর্তি নিয়ে জনমানসে বহাল তবিয়তে আছেন। যেমন, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বাকিদেরও পরিবার বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লোককে সাফাই গেয়ে বেড়াতে হয় নি। একমাত্র মীরজাফর ছাড়া!
alibardi, jagat seth
আজকের দিনেও আত্মরক্ষার্থে খুন করলে সেটার জন্য কাউকে দোষী সাব্যস্থ করা যায় না। আর, মীরজাফর ও তার সহযোগীদের কাছে ক্ষমতা দখলের চাইতেও সিরাজের অপসারণ - নিজেদের অস্তিত্বের খাতিরেই বেশী জরুরি ছিলো। আজ তো সরকারের থেকে আলাদা বিচার বিভাগ আছে। তখনকার দিনে নবাবের কথাই আইন, নবাবই সবচাইতে বড় বিচারক - এই অবস্থায় এরা নিজেদেরকে বিপন্ন মনে করে এই ষড়যন্ত্র করে থাকলে কোন দিক থেকে এদেরকে দোষ দেবেন? 
mohanlal, mir madan
সবচেয়ে বড় কথা, ১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষের কোন ধারণাই ছিলো না। পলাশীতে সিরাজের হারের পর ধীরে ধীরে ইংরেজরা পুরো দেশকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসে, যেটা থেকে আজকের আধুনিক ভারতবর্ষ, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। ইংরেজরা ভারতের শাসনকর্তা হওয়ায় এবং মুঘলদের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ফলেই না ভারতে আধুনিক শাসন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, বিজ্ঞান ইত্যাদির বিস্তার হয়। যার জন্যে আসলে আমাদের মীরজাফরকে ধন্যবাদ জানানোই উচিত!
পলাশী, রবার্ট ক্লাইভ,  ১৭৫৭
মীরজাফর, সিরাজদৌল্লা, শোভন চক্রবর্তী

No comments:

Post a Comment

Share